স্বাধীনতার অপব্যাখ্যা : মানবতা আজ কোথায়? জামিল আহমদ
ঐতিহাসিক ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। ২৫ শে মার্চের সূর্য চোখ বন্ধ করে আঁধার নামিয়ে আনল। এ সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করল। ঘড়ির কাটা বারটায় পা রাখলে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে তারিখ বদলে গেল। শুরু হয়ে গেল ঐতিহাসিক ২৬ শে মার্চ। এর বেশ কয়েক মিনিট আগে এবং পরে এ দেশের বড় বড় নগর ও শহরগুলোতে পাক বাহিনীরা ছড়িয়ে পড়ল। তারা ঘুমন্ত বাঙ্গালী প্রশিক্ষণার্থী সৈনিকদের উপর আক্রমণ শুরু করল। একতরফা আক্রমণে শত শত বাঙ্গালী তরুণ সৈনিক শহীদ হয়ে গেল। অনন্তর ধারাবাহিকভাবে রাজারবাগের পুলিশ লাইন্স, পিলখানার রাইফেলস সদর দফতর, সৈয়দপুর সেনানিবাসে আক্রমণ চালাতে থাকে। এরই মাঝে ঐ দিনে দেশ স্বাধীনের তামান্না বুকে নিয়ে গর্জে উঠে বাংলার দামাল সন্তানরা। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬৬ দিন সশস্ত্র সংগ্রামের পর এ দেশ বিজয় অর্জন করে। এর মাধ্যমে এদেশ পাকিস্তানের দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বিশে^র দরবারে স্বাধীন দেশ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। বিশে^র মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে স্থান পায়।
মহান স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ তারিখে হওয়ার কারণে এই দিনটিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। স্বাধীনের পর বাহাত্তর থেকে প্রতি বছরই ২৬ শে মার্চে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এই দিনে আমরা স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নতুনরূপে অবহিত হই। আমরা দেশ প্রেমের প্রেরণা পাই। তবে পরিতাপের বিষয় হল- কতিপয় চরিত্রহীন লোক এই দিবসটির অপব্যাখ্যা করে পরিবেশ দূষিত করছে এবং সকলের ঈমান-আমল নষ্ট করছে। তারা বলে-স্বাধীনতা দিবস মানে মুক্তি দিবস; বাধাহীনতা দিবস। তাই আজ আমরা মুক্ত-স্বাধীন। যা খুশি তাই করব। কেউ আমাদেরকে বাধা দিবে না, বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নেই। এই শ্রেণীর গুটিকয়েক বলে- শুধু ২৬ শে মার্চ নয় বরং বছরের ৩৬৫ দিনেই আমরা স্বাধীন। পাকিস্তান থেকে এদেশ তো চিরকালের জন্য স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাই আমরাও চিরস্বাধীন। যখন যা খুশি তাই করার অধিকার আমাদের আছে। আমাদের স্বাধীনতা, আমরা যেমন খুশি তেমন চলাফেরা করব। বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নেই।
তারা স্বাধীনতার যে ব্যাখ্যা করে থাকে সেটা কি সঠিক কিনা তা আমাদের ভাল করে জানতে হবে। তারা স্বাধীনতাকে যে অর্থে ব্যবহার করে সেটা নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণের জন্য করে থাকে। যা আদৌ সঠিক নয়। বরং স্বাধীনতা বলা হয়, অন্যের দাসত্ব থেকে নিস্তার পাওয়াকে। স্বাধীনতার এই অর্থটা ভাষাবিদগণ আরবী মু‘জামগুলোতে লিখেছেন। আর এটাই স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ। যেহেতু স্বাধীনতা মানে অন্যের দাসত্ব থেকে নিস্তার পাওয়া সেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানে পাকিস্তানের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া। পাকিস্তানী শাসনের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার মানে তো এটা নয় যে, বাংলাদেশে বাস করে যা খুশি তাই করা যাবে। ইচ্ছা-স্বাধীন চলাফেরা করা যাবে। তাহলে তো মানুষ আর পশুর মাঝে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সম্প্রতি স্বাধীনতার এই অপব্যাখ্যায় দেশ প্লাবিত হয়ে গেছে। মানবতা যেন আজ বন্যতায় পরিণত হয়েছে । স্বাধীনতার নাম নিয়ে বন্য হয়ে যাওয়া কি মানুষের সাজে? এটা কি কোন সুস্থ বিবেক মেনে নিতে পারে? নিশ্চয়ই নয়। তবে কেউ যদি কবির মতো ঘাড় ফুলিয়ে বসে থাকে-
“তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য
আমি না হয় পাখিই হব
পাখির মতো বন্য।”
তাহলে তার বন্যতাকে কে ঠেকাতে পারে ? অথচ এখন এই বন্যতারই উন্মাদনা চলছে গোটা সমাজে, এই পশুত্বই চলছে সারা দেশ জুড়ে। পরিণামে মানুষের মর্যাদা পদে পদে ভুলণ্ঠিত হচ্ছে।
মানুষ আজ স্বাধীনতার অপব্যাখ্যা করে উগ্র আধুনিকতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছে। এই উগ্র আধুনিকতার সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার মানববংশের অন্যতম অংশ নারী সমাজ। সম্ভ্রমের রাজটিকা দলিত করছে নারী নিজেই স্বাধীনতার মোহান্ধতায়। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, বিদ্যালয়, মার্কেট, পার্ক, বিনোদনস্পট তারপর মিডিয়া এই সবকিছু মিলে নারীকে স্বাধীন বানালো, কাঁড়ি কাঁড়ি সুযোগ-সুবিধা দিল। এর শেষ পরিণতি কী হল ? যার ফসল স্বরূপ কত লোমহর্ষক খবর আমরা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। তখন লজ্জায় আর মাথা উঁচু করার পরিস্থিতি থাকে না। এমন স্বাধীনতার ফলে বর্তমান বিশে^ নোংরামি কতটা বেড়ে গেছে তার কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করছি।
বর্তমান বিশে^র পরাশক্তি আমেরিকায় নারী স্বাধীনতার নমুনা হলো, সেখানে প্রতি পনের সেকেন্ডে একজন নারী নির্যাতিতা হচ্ছে। প্রতি বছর বিশ লাখ থেকে চল্লিশ লাখ নারী তাদের সঙ্গীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। [ দৈনিক ইনকিলাব, ২১ জুলাই ১৯৯৪ ইং]
আমেরিকান হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পূর্বেই শতকরা চুরাশি জন ছাত্রী যৌন নিগ্রহের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এরপর হাইস্কুলের শতকরা সাতাত্তর জন এবং কলেজের শতকরা ঊনপঞ্চাশ জন ছাত্রী ব্যভিচারে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। নারী স্বাধীনতার ধারক-বাহক ব্যালিফোর্নিযার এক তথ্যে জানা যায়, আমেরিকার এক বিদ্যালয়ে পাঁচশত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শতকরা আঠার জনই হচ্ছে অবৈধ সন্তান। [নিউজ জার্নাল, অক্টোবর ১৯৯৪ ইং]
১৯৮৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৯% আমেরিকান পুরুষ স্ত্রীদেরকে দৈহিকভাবে নির্যাতন ও মারধর করে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সীতে আগত রোগীদের ১৭% স্বামী কিংবা বয়ফ্রেন্ডের নির্যাতনের শিকার বলে পরিসংখ্যানে জানা গেছে। এ সংখ্যা ট্রপিক চুরি ও ধর্ষণের তুলনায় অনেক বেশি।
যে সকল নারী কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারী দফতরে চাকুরীরত তাদের শতকরা বিয়াল্লিশ জন সহকর্মীদের যৌন নিপীড়ন ও ইভটিজিং এর শিকার হয়। প্রদেশিক সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত নারীদের মধ্যে শতকরা ষাট জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৭০% এ। শুধু ১৯৯১ সালে আমেরিকায় পারিবারিকভাবে ১১ লাখ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯২ সালে এই সংখ্যা হয়ে যায় প্রায় ৩০লাখ।
আমেরিকান সৈন্যবাহিনীতে ৫২% নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শতকরা ২০ জন নারী জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আট বছরের শিশু পর্যন্ত এ নিপীড়ন থেকে বাদ পড়েনি।
আমেরিকান কলাম লেখক হ্যারাস দেশটির এগারোটি প্রদেশে জরিপ করে বলেছেন জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার মেয়েদের ৫০% এর বয়স আঠার বছরের কম এবং ২৫% এর বয়স বারো বছরেরও কম। জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের অধীনে সম্পাদিত জরিপে দেখা গেছে, বারো বছরের কম বয়সী কিশোরীদের মধ্যে ২০% আপন পিতার যৌন আক্রমণের শিকার এবং ৪৬% ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন ও ৩০% বন্ধুদের দ্বারা নির্যাতিতা হয়েছে। [বেদার ডাইজেস্ট, ফেব্রুয়ারি ২০০৫]
এই তো স্বাধীনতা ও অধুনিকতার ফলাফল। এই তো তার অভিসরণের ফসল। আমেরিকার এই স্বাধীনতাকে যে অনুসরণ করবে তার অবস্থা এমনই হবে, পস্তাতে হবে আমেরিকান নির্যাতিতা নারীর মত। অবশ্য কিছু চরিত্রহীন বাঙ্গালী নারী-পুরুষের চলাফেরা দেখলে মনে হয়, তারাও আমেরিকান হতে চায় এবং তাদের মত বেহায়াপনা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে এমন পরিবেশ গড়ে উঠেছে। একজন লেখিকা একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার সূত্র উদ্ধৃত করে লেখেন যে, এক বিশ^বিদ্যালয়ের দেয়ালে একটি প্রশ্ন লেখা দেখলাম, ‘হে কুমার! তুমি বিয়ে করতে নারাজ কেন ?’ প্রথমে কিছুটা চিন্তিত হলেও পরক্ষণেই তার নিচে জবাব লেখা দেখলাম, ‘বাজারে দুধ সস্তা পেলে কে আর কষ্ট করে গাভী পোষে ?’ [ধন্য আমি নারী, পৃষ্ঠা নং ৩২]
আচ্ছা, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এজাতীয় কথা লেখা থাকে সে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা কী শিখবে ? তাদের মনোভাব কেমন হবে ? যে স্থানে এইরকম বাক্যের আলোচনা হয় সেখানকার নারী-পুরুষের চরিত্র কেমন হবে ? তাদের পরস্পরের চাল-চলন কেমন হবে ? নিশ্চয় আমেরিকান বেহায়াদের মত। আর এরাই বাংলার সুন্দর ও সুষমাময় পরিবেশকে দূষিত করছে, এদেশের মুক্ত বাতাসকে ভারী করে তুলছে। কোথায় পালায়ন করেছে আজ মানবতা ? কোথায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে আজ বিশ^-সভ্যতা ? জানি এ প্রশ্নগুলোর ন্যায়সংগত কোন উত্তর আমি পাব না। কেননা, আজকের স্বাধীন সভ্যতা পচেগলে নষ্ট হয়ে গেছে।
এ ধরনের আরো বহু ঘটনা উপস্থিত করা যাবে। শিক্ষা গ্রহণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট মনে করে আজ আর উল্লেখ করলাম না। বস্তুত এসকল ঘটনার জন্য লম্পট পুরুষদের অসংযত চোখের হিং¯্রতা, কুপ্রবৃত্তি ও নষ্ট চরিত্রের নোংরামি যেমন দায়ী তেমন মেয়েদের উগ্রসাজ, বেপরোয়া চলাফেরা ও আকর্ষণকারী ভাবভঙ্গি কম দায়ী নয়। তাই এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ইসলামপ্রদত্ত পর্দা ব্যবস্থা ও বাহ্যিক-আত্মিক সকল পবিত্রতার গ-ি রক্ষা করাই হল সমাধান।
ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলিম জাতি। মন চাহে জিন্দেগী আমাদের নয়, বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার দেখে পশুত্ব ও বেহায়াপনা করা মুসলিম সমাজের ধর্ম নয়। মুসলিম তো সর্বদা একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করবে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মেনে চলবে। কেননা, মানব চিত্তের প্রতিটি মুহূর্তের সকল বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা সম্যক অবগত আছেন। তিনি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতাকে সামনে রেখেই তাঁর নবীর মাধ্যমে ইসলামী বিধানসমূহ প্রেরণ করেছেন। যা সর্বকালের সর্বোপযোগী শাশ^ত জীবন বিধান। এ জন্যই যুগে যুগে মানব সভ্যতার হাজারো পরিবর্তনের ভিড়ে ইসলামী আইন ও বিধান অক্ষুণœ রয়েছে। পক্ষান্তরে মানুষ আধুনিকতার যুগ-চাহিদা ও প্রগতির দাবীর অজুহাতে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানসমূহের বিপরীত যত নতুন রীতি-নীতির উৎপত্তি ঘটিয়েছে সেগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মানবসমাজে শান্তির প্রতি হুমকি ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই নিজ স্বাধীনতা ছেড়ে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী বিধানসমূহ পালন করে উভয় জাহানে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে।
Leave a Reply