জীবনজিজ্ঞাসা
মাযারে ওরস, বিশ্বজাকের মঞ্জিল ও বিশ্ব ইজতেমায় যাওয়ার হুকুম প্রসঙ্গে
আলহাজ্ব আবদুর রহমান সাহেব, রিকাবী বাজার, মুন্সিগঞ্জ সদর।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের ভাবপ্রবণ মানুষ বিভিন্ন মাযারে, ওরশে, বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে এবং প্রতি বৎসর টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমাতে উপস্থিত হয়ে থাকে। টঙ্গী ইজতেমায় উপস্থিত হওয়া বাস্তবে কোন গুরুত্ব রাখে কি?
উত্তর : শরীয়তের দৃষ্টিতে ওরস ও মাযারে সমবেত হওয়া বেদ’আত ও নাজায়িয। কারণ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পূর্বে উম্মতকে তাঁর মাযারে অনুষ্ঠান করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করে গেছেন। সুতরাং একজন মুসলমানের জন্য ঐসব অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া কোনভাবেই জায়িয নয়। আর আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য হক্কানী পীর বা বুযুর্গের নিকট যাওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে আবশ্যিক কাজ। কারণ, নিজের ক্বলব থেকে দুনিয়ার মোহ, রাগ, হিংসা, ফখর, ও রিয়া, ইত্যাদি খারাপ খাছলতগুলো দূর করে আখেরাতের মহব্বত, ন¤্রতা, ইখলাস, শোকর, সবর, প্রভৃতি ভাল খাছলত হাসিল করা জরুরী। এগুলো হাছিল না করলে দিলের রোগের কারণে সারা যিন্দেগীর আমল বরবাদ হয়ে যেতে পারে। যেমন, হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম যে তিন ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, তারা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে নেকীর পাহাড় নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু ইখলাস না থাকার কারণে তাদের সমস্ত নেকী বাতিল হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, বর্তমান যামানায় হক্কানী পীর তাকে বলা হয়, যার মধ্যে দশটি আলামত পাওয়া যায়, বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন। [থানবী রহ. এর লিখিত কসদুস সাবীল নামক গ্রন্থ]
অপর দিকে দুনিয়াদার ও ব্যবসায়ী
পীরের সংখ্যা বর্তমানে খুবই বেশী। বিনা পুঁজিতে ব্যবসা হিসেবে জনসাধারণের ধর্মীয় জ্ঞানের স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে বহু ব্যবসায়ী পীর আস্তানা গেড়ে সাধারণ মানুষের অবশিষ্ট দ্বীন-ঈমানটুকু বিনষ্ট করার ফাঁদ পেতে বসেছে। তাই এদের দরবারে যাওয়া কিছুতেই জায়িয হবে না। এসব পীরদের মধ্যে দশটি আলামতের একটি পাওয়া যায় না। যারা যায়, তারাও পীরের দরবারে যে একমাত্র আল্লাহকে পাওয়ার জন্য যেতে হয় তা জানে না। তারা সেখানে গিয়ে পীরের পায়ে সেজদা করে, কবরে তাওয়াফ করে, পীরের পা বা কবর চুম্বন করে, পীর বা মাজারের নামে মান্নত করে প্রভৃতি শরীয়ত গর্হিত কাজ করে থাকে। এরা পীরের কাছে মামলা-মুকাদ্দমায় জয়লাভ, ব্যবসা বানিজ্যে উন্নতি ও রোগ-শোক থেকে মুক্তি লাভের জন্য গিয়ে থাকে। ভ- পীরদের কাছে বাতিল মাকসাদ নিয়েই লোকেরা বেশীরভাগ গিয়ে থাকে। সাধারণ মুসলমানদের উচিত, হক্কানী উলামায়ে কিরামের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে শুনে কোন বুযুর্গের নিকট যাতায়াত করা।
তাবলীগী মেহনত সকল হক্কানী উলামায়ে কিরামের মতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সর্বশ্রেণীর মুসলমানদের বিশেষ করে সাধারণ মুসলমান ভাইদের দ্বীন ও ঈমান শিক্ষার জন্য বর্তমান যামানায় তাবলীগী জামাআতের কর্মসূচী খুবই সুন্দর। এ ব্যাপারে সমস্ত হক্কানী উলামায়ে কিরাম একমত। হযরত সাহাবায়ে কিরাম রা. এ ধরনের পদ্ধতিতে মেহনত করেই দ্বীন ও ঈমান শিখতেন এবং শিখাতেন। এ ধরনের দাওয়াত যখন বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সেই এলাকার জনসাধারণ থেকে দ্বীনও বিদায় নিতে থাকবে। স্পেন ও রাশিয়া ইত্যাদি তার নযীর।
আজ আমাদের দেশসহ সকল বিশ্বে অসংখ্য বিধর্মী এই দাওয়াতের উসীলায় ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। এ দাওয়াতে বহু স্থানের গির্জা ও মন্দির মসজিদে পরিণত হচ্ছে। বহু নামধারী মুসলমান এই মেহনতের উসিলায় পূর্ণ দ্বীনদার হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করছে। সেই যবরদস্ত মেহনতকে আরো ব্যাপক করার জন্য টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতিমার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই ইজতিমায় বিদেশ থেকে বুযুর্গানে দ্বীন তাশরীফ আনেন। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের অসংখ্য লোক তাদের বয়ান শুনে। সেই ইজতিমা আর ওরস, মাযারকে এক সমান মনে করা মারাত্মক ভুল। দু’টোর মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। একটা হিদায়াতের পথ। আর অন্যটা গুমরাহীর পথ। আল্লাহ তাআলা সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন।
রোগাক্রান্ত গরু-ছাগলের হুকুম প্রসঙ্গে
মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান, মধুপুর, সিরাজদিখান।
প্রশ্ন : কোন হাঁস-মুরগী বা গরু-ছাগল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর নিকটবর্তী হলে মৃত্যুর পূর্বে ঐ হাঁস-মুরগী বা গরু-ছাগল যবেহ করে খাওয়া যাবে কি না?
উত্তর: গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগী বা যে কোন হালাল প্রাণী রোগের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হলে, মৃত্যুর পূর্বে তা শরীয়ত মুতাবেক যবেহ করে খাওয়া হালাল। যদি রোগের তীব্রতা সত্ত্বেও প্রাণীর অবস্থা এমন থাকে যে, সাধারণত, কোন সুস্থ প্রাণী যবেহ করে ছেড়ে দিলে তার মধ্যে যে পরিমাণ হায়াত বাকী থাকে, ততটুকু জীবন এখনও তার মধ্যে আছে, সে ক্ষেত্রে সেটা জবেহ করে খাওয়া হালাল। মোটকথা, রোগের কারণে যদি নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে, এবং
যবেহ করার পরে নড়াচড়া করা বা প্রবাহমান রক্ত পাওয়া গেলে, হালাল হবে। আর যবেহ করার পরে নড়াচড়া বা প্রবাহমান রক্ত না পাওয়া গেলে, এমন প্রাণী মৃত বলে গণ্য হওয়ার কারণে হারাম হবে। [ফাতওয়ায়ে বাযযাযিয়া, ৬: ৩০৫# তাবয়ীনুল হাকায়িক, ৫: ২৯৭]
মসজিদের পার্শ্বে দাফন করা প্রসঙ্গে
ইমদাদুল হক, জারিয়া, ঝাঞ্জাইল, দুর্গাপুর।
প্রশ্ন : মসজিদের পার্শ্বে দাফন করা উত্তম না কবরস্থানে? জানতে ইচ্ছুক।
উত্তর: মুসলিম মাইয়্যিতদের ওয়াক্ফকৃত গোরস্থানে দাফন করাই উত্তম। কারণ, কবরের কিছু হক এমন আছে, যা গোরস্থানে ছাড়া সহজে আদায় হয় না। যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে অন্য কোথাও নিজের বা পরিবারের কবরের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে রেখে থাকে, তাহলে এটাও জায়িয আছে। চাই সে জায়গা মসজিদের পার্শ্বেই হোক বা দূরে কোথাও হোক। তবে মসজিদের ওয়াক্ফকৃত স্থানে (চাই মসজিদের আশ-পাশে হোক বা দূরে) কবর দেয়া জায়িয নয়। হ্যাঁ, মসজিদের পার্শ্বে নিজস্ব জমিনের বা জমি ক্রয় করে অথবা অন্য কারো জমিতে মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে কবর দেয়াও উত্তম। [ফাতওয়ায়ে শামী, ২: ২৩৫# ফাতওয়ায়ে দারুল উলূম, ৫: ৪০৭-৪০৭]
নামাযে চোখ বন্ধ করা প্রসঙ্গে
আবদুল গাফ্ফার, মধুপুর, সিলেট।
প্রশ্ন : আমি নামাজের মধ্যে অধিকাংশ সময় দাঁড়ানো এবং বসা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে রাখি। কারণ এর দ্বারা আমার নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টি হয় এবং খুশু-খুজুর ব্যাপারে আমি নিশ্চিত থাকি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এতে আমার নামাজের কোন ক্ষতি হবে কি?
উত্তর : সম্পূর্ণ নামাজে চক্ষু বন্ধ করে নামাজ পড়া মাকরূহে তানযীহী। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টি করার জন্য মাঝে মধ্যে চক্ষু বন্ধ করে এবং মাঝে মাঝে খোলে, তাহলে নামাজ মাকরূহ হবে না। যেমন, চক্ষু বন্ধ করে কিরাআত পড়ে এবং রুকূতে
যাওয়ার সময় চোখ খোলে, তাহলে তা জায়িয আছে। তবে সমগ্র নামাযে চক্ষু বন্ধ রাখা যাবে না। মাঝে মধ্যে খুলতে হবে। নতুবা সুন্নাতের পরিপন্থী হওয়ার দরুণ মাকরূহ হবে। [ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম, ৪: ১০৯]
মেয়েরা নামাজে জোরে কুরআন পড়া প্রসঙ্গে
ফারিহা জান্নাত শিফা, কলমাকান্দা, আলীম মাদরাসা।
প্রশ্ন : মেয়েরা ঘরের নিভৃতে যেখানে কোন গাইরে মাহরাম পুরুষ পৌঁছতে পারে না, সেখানে রাতে নফল নামাজে কিরআতে গুণগুণ আওয়াজে পড়তে পাড়বে কিনা?
উত্তর : এতটুকু গুণগুণ করে যদি পড়ে যে, শুধু তার কানে আওয়াজ পৌঁছে বা এক দেড় হাত দূর পর্যন্ত আওয়াজ যায় তাহলে তা জায়িয আছে। এর চেয়ে বেশি জোরে আওয়াজে যদি হয় যাতে ২/৩ হাত দূরের লোকেরা পড়ার আওয়াজ বুঝতে পারে তাহলে নামাজ ফাসিদ হয়ে যাবে। কেননা, মেয়েরা ফরজ, নফল সবধরনের নামাজে কিরাআত আস্তে পড়বে। আর আস্তে কিরআত পড়ার পরিমাণ হল সে নিজ কানে শুনবে। পার্শ্ববর্তী কেউ থাকলে সেও শুনতে পারবে। [মাআরিফুস সুনান, ৩: ৪৩৫, দারুল উলূম, ২: ২১৯, ২৬৬]
গোসলের পর নতুন উযু করার হুকুম প্রসঙ্গে
মো. আবু তাহের, মাদানী নগর, সিদ্ধিরগঞ্জ।
প্রশ্ন : গোসল করার পূর্বে আমরা যে উযু করি, গোসল করার পরে নামাজ পড়ার জন্য আবার নতুন করে উযু করতে হবে কি না? প্রমাণসহ জানালে উপকৃত হব।
উত্তর : গোসল করার পূর্বে উযু করা হোক বা না হোক, গোসল করার পরে নামাজ পড়ার জন্য আবার নতুন করে উযু করতে হবে না। গোসলের পূর্বের উযু বা শুধু গোসল দ্বারা নামায হয়ে যাবে। কেননা, গোসলের মধ্যে উযুর অঙ্গ ধৌত হয়ে যায়। এ কারণে মাকরূহে হবে। তবে উযু থাকা অবস্থায় আবার উযু করতে চাইলে,
সেখানে মাসআলা হল, প্রথম উযু দ্বারা এমন কোন ইবাদত করবে, যা উযু ব্যতীত করা যায় না। যেমন-কমপক্ষে দু’রাকআত নামায পড়া। অবশ্য যদি কেউ পবিত্রতার নিয়্যত ব্যতীত গোসল করে এবং পূর্বে উযু না করে তাহলে সে ক্ষেত্রে উযুর সওয়াব প্রাপ্তির জন্য পুনঃ উযু করা মুস্তাহাব। [আহসানুল ফাতওয়া, ২:৯, আপকে মাসায়িল আওর উনকা হল, ২: ২৭, রুদ্দুল মুহতার, ১: ১১৯]
বাকী টাকায় গাভী ক্রয় করে দুধের দ্বারা মূল্য পরিশোধ করা প্রসঙ্গে
আব্দুল বারেক, ধোবাউরা, ময়মনসিংহ।
প্রশ্ন : সমিতির পক্ষ থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে গাভী ক্রয় করে কোন ব্যক্তিকে দেয়া হলো যে, প্রতিদিন সকাল-বিকাল বার টাকা লিটার হিসেবে দুধ দিয়ে গাভীর টাকা পরিশোধ করবে। উল্লেখিত সুরত শরীয়াত সম্মত কি না? জানতে ইচ্ছুক।
উত্তর : আপনি গরু বিক্রির যে সুরত উল্লেখ করেছেন, গাভীর নির্দিষ্ট দাম ঠিক করে বাকীতে বিক্রি করার পরে ক্রেতার নিকট থেকে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ দিয়ে গাভীর মূল্য পরিশোধ করবে। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় শরীয়াত সিদ্ধ নয়। কেননা, শরীয়াতে এমন শর্তের সাথে ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ। যাতে ক্রেতা বা বিক্রেতার অতিরিক্ত ফায়দা হাসিল হয়। আপনাদের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে যেহেতু এমন শর্ত আরোপ করা হয়েছে অর্থাৎ, নির্দিষ্ট মূল্যে নির্দিষ্ট পরিমান দুধ দিয়ে মূল্য পরিশোধ করবে। অথচ, বাজারে এক লিটার দুধের মূল্য বার টাকার কম বেশি হতে পারে। অতএব, আপনাদের উক্ত ক্রয়-বিক্রয় সহীহ হবে না। তবে ক্রেতার কাছ থেকে বৈধভাবে কিস্তিতে টাকা গ্রহণ করতে চাইলে প্রতিদিন বা প্রতিমাসে কত টাকা দিতে হবে তা নির্ধারিত করে দিবে। তারপর যদি ক্রেতা টাকার পরিবর্তে বাজারদর হিসেবে দুধ দিয়ে কিস্তি শোধ করে, তাহলে শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাতে কোন অসুবিধা নেই। [ফাতওয়ায়ে মাহমূদিয়া, ১৩: ৩৩২]
Leave a Reply