অসুস্থ ব্যক্তির আত্মিকসেবা ও ধর্মীয় অধিকার : মমিনুল ইসলাম মোল্লা
মুসলিম পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তাকে মুসলিম ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাওয়া তার ধর্মীয় অধিকার। ভাল মুসলিম ডাক্তার পাওয়া না গেলে ভিন্ন কথা, তবে চিকিৎসা যদি ঝাড়-ফুঁক জাতীয় হয় তাহলে অবশ্যই চর্চাকারী মুসলিম হতে হবে। কুরআনের আয়াত বা সহিহ হাদিসের দুয়া দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে আরোগ্যদাতা একমাত্র আল্লাহ। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন পরিবারের কোন রোগী দেখার পর নিজের ডান হাত তার ব্যাথার যায়গায় ফিরাতেন এবং একটি দোয়া পড়তেন । দুয়াটি এরকম “হে আল্লাহ! মানুষের প্রতিপালক। তুমি কষ্ট দূর কর এবং আরোগ্য দান কর। [বুখারি-মুসলিম]
আমাদের পরিবারের স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা অসুস্থ হলে আমরা প্রথমেই ভাবি পল্লী চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যাব। এখানে সমস্যার সমাধান না হলে উপজেলা, জেলা কিংবা রাজধানীর কোন বড় ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাব। কিন্তু এ কথা আমাদের অনেকেরই মনে আসে না ওনার কিছু ঋণ আছে সেটি পরিশোধ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের ডায়াবেটিস, শ^াসকষ্ট, অথবা নিয়মের মধ্যে চললে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় এমন কোন রোগে আক্রান্ত হলে আমরা অনেকেই ভাবি না রোগীর হজ¦ ফরয হয়েছে তার হজ¦ করার ব্যাপারে আর দেরি করা চলবে না। বিশেষ করে আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক হজে¦ যায় স্ত্রী , পুত্র কিংবা নাতীদের কর্মক্ষমতার সময়। এসময় বৃদ্ধ ব্যক্তিটি হজে¦র টাকা যোগাতে হয়তো স্ত্রী কিংবা ছেলে-মেয়েদের সাথে পরামর্শ করেন। তখন কেউ কেউ বলেন, আপনার ছেলেকে একটি চাকুরির ব্যবস্থা না করে, ছোট মেয়েটিকে বিয়ে না দিয়ে আপনি কিভাবে হজে যাবেন? হজ ফরজ হওয়া ব্যক্তিটি কোন বিশেষ রোগের প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করলে তিনি এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের উচিত তাকে আর্থিক ও মানসিকভাবে সাহায্য করা। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু নোমান রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। [বুখারী : হাদীস নং ৪৮০৯]
আপনার রোগী যদি একই সময়ে ডায়াবেটিস ও হাঁটু কিংবা মেরুদন্ডের সমস্যায় ভোগেন তাহলে আগে দেখবেন কোনটির কারণে তার নামাজ অথবা অন্য কোন ইবাদতে সমস্যা হচ্ছে। অর্থাৎ রোগীর দৈহিক সেবার পরিবর্তে আত্মিক সেবার দিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কিছু হাসপাতাল বা কিনিক রয়েছে যেগুলোতে স্বল্পমূল্যে বা নাম মাত্র মূল্যে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থ বাঁচানোর জন্য আপনি একজন মুসলিম তত্বাবধায়ক হিসাবে আপনার রোগীকে সেখানে ভর্তি করতে পারবেন না। এতে আপনার ঈমানের সমস্যা হতে পারে তাওহীদের ঘাটতি হতে পারে। রোগীর দৈহিক সেবা পাওয়ার অধিকার তার স্বজনদের নিকট রয়েছে। তেমনি আত্মিকি সেবা তথা ধর্মীয় সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। তাই মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় দেখতে হবে কোন বেডে দিলে তিনি কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়তে পারবেন। এ ধরণের বেডকেই প্রাধান্য দিতে হবে, এ ধরণের কক্ষে জানালার গ্লাস ভাঙ্গা থাকলেও আত্মিক সেবার কারণে এ কক্ষকেই প্রাধান্য দিতে হবে। হাসপাতালের অধিকাংশ বেডে পাশাপাশি অবস্থায় সেজদা দেয়া যায় না। অসুস্থ অবস্থায় হয়তো পবিত্রতা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। রোগী যদি পানি না পায় অথবা পানি ব্যবহার করলে যদি রোগের তীব্রতা বেড়ে যায় তখন অন্য কিছু দিয়ে লজ্জাস্থান পরিষ্কার করে দিতে হবে। শুধুমাত্র টিসু বা ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করে নামায আদায় করতে পারবেন। কুলুখ ব্যবহার করলে বিজোড় সংখ্যক কুলুখ ব্যবহার করার কথা সহিহ হাদিসে বলা হয়েছে। [বুখারি : ওজু অধ্যায়]
রক্ত বা পুঁজ নিয়েও নামাজ আদায় করা যাবে। এজন্য নামাজের কোন ক্ষতি হবে না। মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রা. থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, যে রাতে ওমর রা. বর্শা দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সে রাতে তিনি তার নিকট গিয়ে তাকে ফযরের নামায আদায় করার জন্য জাগিয়ে দিলেন। তখন ওমর রা. বললেন, হ্যা অবশ্যই আমি নামায পড়ব। কেননা যে ব্যক্তি নামায পড়ে না ইসলামে তার কোন অংশ নেই। এ বলে তিনি নামায আদায় করলেন। তখন তার দেহ থেকে রক্ত ঝরছিল। [মুয়াত্তা-মালেক]
বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত সবই মুমিনের কল্যাণের জন্য, এটি হয়তো আমরা সব সময় বুঝতে পারি না। মুমিনের কাছে সুখের কিছু এলে সে শুকরিয়া আদায় করে। আর এটি তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। অনুরূপভাবে যখন কোন দুঃখ তাকে স্পর্শ করে তখন সে ধৈর্য ধারণ করে। আর এটাও তার কল্যাণের কারণ। [মুসলিম]
তাই মুমিনের উচিত, দুঃখ-কষ্টের সময় সবুর করা। আল্লাহর ফায়সালায় খুশী থাকা এবং সবরকারীদের জন্য তিনি যে পুরস্কারের অঙ্গীকার করেছেন তা প্রাপ্তির আশা রাখা। ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহর সীমাহীন প্রতিদান রয়েছে। আমরা প্রতিদিন স্বাভাবিকভাবে যে কাজগুলো করি অসুস্থ হলে সেগুলা করতেই আমাদের কষ্ট লাগে। কেউ অতীতে নিয়মিত অধিক রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস থাকলে অসুস্থ হলে কম করে হলেও এ অভ্যাস চালু রাখা উচিত। আর তাকে তার সেবাদানকারী ব্যক্তি এক্ষেত্রে সহযোগীতা করতে পারবেন। মনে রাখবেন তিন বেলা সময়মত ওষুধ খাওয়ানোর চেয়েও তাহাজ্জুদের সমময় জাগিয়ে দেয়া উত্তম। নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায়করাী তার অভ্যাস চালু রাখার চেষ্টা করলে তিনি পূর্ণ সওয়াব পেয়ে যাবেন। আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন কোন ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফর করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থ ও মুকীম অবস্থার নেকামলের (অনুপাতে) ছাওয়াব দান করেন। [বুখারি, আবু দাউদ]
তাই অসুস্থ অবস্থায় কষ্ট করে হলেও নফল আমল চালু রাখতে হবে। সুস্থ হয়েই বেশি করে ইবাদত করব এ ধরণের ভাবনা মনে আনা উচিত হবে না। কুরআনের সূরা বা আয়াত মুখস্ত থাকলে বিছানায় শুয়ে তা তিলাওয়াত করতে পারেন। প্রতি অক্ষরে এতে আপনি ১০ নেকি করে পাবেন। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেস্তাগণ নবীর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করে (অনুগ্রহ প্রার্থনা করে) এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। [সূরা আল আযহাব : আয়াত ৫৬]
আপনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও রাসুলের উপর সালাত ও সালাম পাঠাতে পারেন। এজন্যও অজু কিংবা পবিত্রতার বাধ্যবাধকতা নেই। দোয়া এক ধরণের ইবাদত। তবে দোয়া মানে মনে যা আসে তা বলা নয়। একজন রোগী হাদিসে উল্লেখিত দোয়াগুলি পাঠ করতে পারেন। প্রথমে কুরআনে বর্ণিত দোয়াগুলো পাঠ করবেন, তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ ও সালাম পেশ করবেন। অতঃপর নিজের জন্য কিছু চাইবেন। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদিন এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে নামায পড়ে দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাফ করো এবং আমার উপর রহম করো। তখন রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওহে মুসল্লি! তুমি খুব জলদি করেছ। যখন তুমি নামাজ পড়বে তখন প্রথমে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে, তারপর আমার উপর দুরুদ পাঠ করবে এবং পরিশেষে নিজের জন্য দোয়া পাঠ করবে। [তিরমিজি]
দান করা মহৎ কাজ। অসুস্থ অবস্থায় নফল দান বেশি বেশি করে করা যায়। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন বলেন, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যায় কর এবং স্বীয় হস্ত ধবংসের দিকে প্রসারিত করো না। আর হিতসাধন করতে থাকো। নিশ্চয় আল্লাহ হিতসাধনকারীদের ভালোবাসেন [সূরা বাকারা : আয়াত ১৯৫]
অসুস্থ ব্যক্তির দেহ পাক, শরীর পাক ও নামাযের যায়গা পাকের ব্যাপারে তার পরিচর্যাকরীরা অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। বাবা ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে এখন নামাজের জন্য ডাক দেয়া যাবে না, একথা বলা যাবে না। পাশাপাশি সেবদানকারীরাও সঠিক সময়ে নামায আদায় করবেন। কষ্ট করে ওজু করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। রোগী যদি পানি ব্যবহার করতে সক্ষম না হন তাহলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা যেতে পারে। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে মুহাম্মদ ইবনে সালাম রা. বর্ণিত, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু হাত মাটিতে মারলেন। তারপর তা ঝেড়ে নিলেন তারপর তা ঝেড়ে নিলেন এবং তা দিয়ে তিনি বাম হাতে ডান হাতের পিঠ মাসাহ করলেন কিংবা রাবী বলেছেন, বাম হাতের পিঠ ডান হাতে মাসাহ করলেন। তারপর হাত দুটি দিয়ে তার মুখমন্ডল মাসেহ করলেন [বুখারী : হাদীস নং ৩৪০]
অসুস্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে শুয়ে বসে যেভাবে সে সুবিধা মনে করে সেভাবেই নামায আদায় করতে পারেন। আমাদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কেউ অসুস্থ হলে আমরা তাদের সেবা করি। আমাদের সমাজে কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের প্রচলিত কথা হচ্ছে, যে রোগ হয়েছে তাতে আর আশা নেই, তোমার যতটুকু দায়িত্ব, যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করো। যদিও ভাল করার মালিক আল্লাহ তারপরও এ কথা শুনে অনেকেই চিকিৎসার ক্ষেত্রে হাল ছেড়ে দেন এবং রোগী তাতে কষ্ট পায়। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কুতায়বা ইবনু সাইদ রহ. আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা ক্ষুধার্তকে খাবার দাও, রোগীর সেবা কর, এবং কয়েদীকে মুক্ত কর। [বুখারি : হাদিস নং ৫২৪৬]
তবে দৈহিক চিকিৎসার পাশাপাশি সে যাতে ইবাদতে মন দিতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক : সহ-সভাপতি হিউম্যান রাইটস এন্ড প্রেস সোসাইটি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা
Leave a Reply